মানুষের জীবনে বোধ সঞ্চারের এক নির্ভেজাল উপাদানের নাম কবিতা। কবিতা কখনো মানুষের মনকে রাঙিয়ে দেয়, কখনো বদনার কালো রঙ ঢেলে উপলব্ধিগুলোকে সতেজ করে তোলে; জীবন দর্শনের পথকে করে প্রশস্ত। আর এ দর্শন ও বোধকে কর্ষণ করেন যে চাষি, তিনি কবি। মানব জীবনের প্রতি নিবিড় অবলোকন করেন তিনি। তারপর শব্দ-বাক্যের ছন্দে ডালি সাজিয়ে পরিবেশন করেন আর দশটি দৃষ্টি ও চিন্তার দরবারে। এভাবেই হয়ে ওঠে কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ।
আবার কবি শক্তিমান। সহজাত প্রতিভা বলে জড় পদার্থে প্রাণ সৃষ্টি করেন কবি। কল্পনার প্রাবল্য কখনো বা শক্ত পাথর চিপে বের করে আনে তরল নির্যাস। একমাত্র কবিই পারেন সময়কে উল্টে-পাল্টে পেছনকে সামনে আর সামনেটাকে পেছনে নিয়ে যেতে। কবিই পারেন বাতাসকে চাদর বানিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিতে, বাতাস থেকে স্বতন্ত্র কোনো ঘ্রাণ আহরণ করতে। অতি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে, কাব্য বিচারে নির্লিপ্ত থেকে আমরা এর প্রতিটি বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেতে পারি ২০১১ সালে প্রকাশিত মুজতবা আহমেদ মুরশেদের 'বুনো বাতাসের ঘ্রাণ' কাব্যগ্রন্থে। বলা যায়, মুজতবার এই বৈশিষ্ট্যগুলোই তাঁর কবিতা নিয়ে লিখতে বাধ্য করেছে। ৩৭টি কবিতায় সাজানো গ্রন্থটি যেন ৩৭টি স্বতন্ত্র রং, ৩৭টি স্বতন্ত্র ঘ্রাণ, স্বতন্ত্র জবানবন্দি; যেন কবিতার মেলা, যেন হরেক রকম পসরা।
মুজতবার কাব্যগ্রন্থ 'বুনো বাতাসের ঘ্রাণ'-এর প্রথম কবিতাটি হলো 'বিস্মরণের পাতা'। অনেক কবি বলে থাকেন, কবিতার অর্থ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। কবি ওয়ালেস স্টিভেনস বলেছেন, 'ধ ঢ়ড়বস হববফ হড়ঃ যধাব ধ সবধহরহম'. এ কথায় বিশ্বাস করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা, 'স্পষ্ট ও অস্পষ্ট'তে অস্পষ্টতাকে অনুমোদন দিয়েছেন, কিন্তু অর্থহীনতাকে দেননি। বরং রবীন্দ্রনাথ তাঁর এ বক্তব্যে অতি স্পষ্টতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ওয়াহিদুল হক বলেছেন, 'কবি শিল্পীই বটেন। কিন্তু ছবি-গানে রূপটাই প্রায় সব, শেষ পর্যন্ত যেন রূপটাই সব। কবি রূপ গড়েন ভাষা দিয়ে, যে ভাষা ভরে থাকে মানুষের সব আপন-কথা দিয়ে, মানুষে-প্রকৃতিতে সব একে-অপরে আনাগোনার কথার প্রতীকীকৃত চিন্ময় অভিজ্ঞতা দিয়ে। কিংবা বুঝি রূপকে সহায় করে কবি অন্য কিছু গড়তে চান, বলতে চান যা বিজ্ঞানের চেয়ে মানবকেন্দ্রিক এবং অন্য সব শিল্পের চেয়েও অনেক বেশি করে কেবল মানুষেরই কথা, মানুষেরই সত্য। এসব বিচারে আমরা দেখি বিস্মরণের পাতা কবিতায় কবি কী বলেন_
এ পাতাটিকে কী আর বৃক্ষে ফেরানো যাবে না?/আশান্বিত ডালে এ পাতাটা কি/আবার শাখার বাঁকে বসে/আমাদের প্রতিপলের আলাপচারিতা দেখবে না?/এ কবিতায় অস্পষ্টতা নেই, অর্থহীন তো নয়ই।
কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, 'ধ ঢ়ড়বস নবমরহং রহ ফবষরমযঃ ধহফ বহফং রহ রিংফড়স'. খাটি কথা। মুরশেদ এখানে সফল। তাঁর 'রৌদ্রের খামে ভরা কথা' কবিতাটি দেখুন_
আমাদের কিছু কথা রৌদ্রের খামে ভরে প্রজাপতি করে দিই।/ওরা উড়ে উড়ে জাদুকরি রাত আনুক কাশের নগরে।/আমাদের কিছু কথা পাশে রেখে, কিছু কথা জাদুঘরে রেখে দিই।
কিছু কথা হয়ে যাক ধানবীজ তিল তিসি যবের দানা জমির পরানে।
পড়লে মনে হবে যেন জীবনানন্দ দাশের কাছ থেকে ধার করা। কবি এ লাইন ধার করেননি। সচেতনভাবে জীবনানন্দনীয় ভাবকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেননি_এই মাত্র। কারণ তাঁর অন্য কবিতাগুলোর কোথাও জীবনানন্দের কবিতার অনুকরণ লক্ষ করা যায় না।
মুজতবা আহমেদ মুরশেদের কবিতা নিয়ে কেন লিখতে গেলাম তার একটি কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি। আধুনিক কবিতা মানে শব্দের কাঠিন্য নয়। আমাদের চারপাশের পরিবেশ, জীবজগৎ ও সমাজ-মনস্তত্ত্বকে সাবলীল উপস্থাপনের দায়িত্ব একজন শক্তিশালী কবিকেই নিতে হয়। মুজতবা সে কাজটি করে যেতে চেষ্টায় আছেন। যথার্থই ঘোরে থাকেন বলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লিখছেন, লিখতে পারছেন। তাঁর গল্প, কবিতা, কিশোর সাহিত্য, নিবন্ধ, প্রবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে দেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকায়। সেসব রচনার পাঠও পাঠককে আনন্দ দেবে বুনো বাতাসের ঘ্রাণের মতোই।
-মহসীন হাবিব
Facebook comments for blogger brought to you by AllBlogTools.com