প্রথম লেখার গল্প

প্রথম লেখার স্মৃতিটা বেশ পেছনের। তবে এতটা বয়স এখনও পার হইনি যে সেটাকে এক মহা ধূসর স্তরের কোন ঘটনা বলে মনে হবে। এখন থেকে হিসেব করলে সাঁইত্রিশ বছর আগের ঘটনা।

নানা রঙের কাব্যগ্রন্থ 'বুনো বাতাসের ঘ্রাণ'

মানুষের জীবনে বোধ সঞ্চারের এক নির্ভেজাল উপাদানের নাম কবিতা। কবিতা কখনো মানুষের মনকে রাঙিয়ে দেয়, কখনো বদনার কালো রঙ ঢেলে উপলব্ধিগুলোকে সতেজ করে তোলে; জীবন দর্শনের পথকে করে প্রশস্ত।

গেরিলা যুদ্ধে নারীর অবদান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে : সেলিনা হোসেন

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্য যাদের হাতে পরিপুষ্ট হয়েছে সেলিনা হোসেন তাঁদের অন্যতম। ইতিহাসকে সমকালীন ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করে কথাসাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন তিনি।

প্রফেসর ইউনুস ও দুর্নীতি এবং আমাদের ভাবমূর্তি

শেখ হাসিনা মধ্যবিত্ত ঝগড়াটে মহিলার মতো আচরণ করে ইউনুস সাহেবের সত্যিকারের কোনো ক্ষতি করতে পারেননি। আর্থিক ও জনপ্রিয়তার বিচারে ইউনুস সাহেবের লাভই হয়েছে।

এক খামখেয়ালি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন

তিনি বেস্টের মতো খামখেয়ালি, মোৎজার্টের মতো শিল্পী, হিটলারের মতো ইহুদিবিদ্বেষী-নারীবিদ্বেষী এবং আলীর মতো চ্যাম্পিয়ন। তিনি রবার্ট জেমস ফিশার বা ববি ফিশার, দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! নিয়মতান্ত্রিক এই দুনিয়ার প্রতি অনিয়মের এক প্রবল পরিহাস।

বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১১

নানা রঙের কাব্যগ্রন্থ 'বুনো বাতাসের ঘ্রাণ'

মানুষের জীবনে বোধ সঞ্চারের এক নির্ভেজাল উপাদানের নাম কবিতা। কবিতা কখনো মানুষের মনকে রাঙিয়ে দেয়, কখনো বদনার কালো রঙ ঢেলে উপলব্ধিগুলোকে সতেজ করে তোলে; জীবন দর্শনের পথকে করে প্রশস্ত। আর এ দর্শন ও বোধকে কর্ষণ করেন যে চাষি, তিনি কবি। মানব জীবনের প্রতি নিবিড় অবলোকন করেন তিনি। তারপর শব্দ-বাক্যের ছন্দে ডালি সাজিয়ে পরিবেশন করেন আর দশটি দৃষ্টি ও চিন্তার দরবারে। এভাবেই হয়ে ওঠে কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ।
আবার কবি শক্তিমান। সহজাত প্রতিভা বলে জড় পদার্থে প্রাণ সৃষ্টি করেন কবি। কল্পনার প্রাবল্য কখনো বা শক্ত পাথর চিপে বের করে আনে তরল নির্যাস। একমাত্র কবিই পারেন সময়কে উল্টে-পাল্টে পেছনকে সামনে আর সামনেটাকে পেছনে নিয়ে যেতে। কবিই পারেন বাতাসকে চাদর বানিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিতে, বাতাস থেকে স্বতন্ত্র কোনো ঘ্রাণ আহরণ করতে। অতি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে, কাব্য বিচারে নির্লিপ্ত থেকে আমরা এর প্রতিটি বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেতে পারি ২০১১ সালে প্রকাশিত মুজতবা আহমেদ মুরশেদের 'বুনো বাতাসের ঘ্রাণ' কাব্যগ্রন্থে। বলা যায়, মুজতবার এই বৈশিষ্ট্যগুলোই তাঁর কবিতা নিয়ে লিখতে বাধ্য করেছে। ৩৭টি কবিতায় সাজানো গ্রন্থটি যেন ৩৭টি স্বতন্ত্র রং, ৩৭টি স্বতন্ত্র ঘ্রাণ, স্বতন্ত্র জবানবন্দি; যেন কবিতার মেলা, যেন হরেক রকম পসরা।
মুজতবার কাব্যগ্রন্থ 'বুনো বাতাসের ঘ্রাণ'-এর প্রথম কবিতাটি হলো 'বিস্মরণের পাতা'। অনেক কবি বলে থাকেন, কবিতার অর্থ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। কবি ওয়ালেস স্টিভেনস বলেছেন, 'ধ ঢ়ড়বস হববফ হড়ঃ যধাব ধ সবধহরহম'. এ কথায় বিশ্বাস করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা, 'স্পষ্ট ও অস্পষ্ট'তে অস্পষ্টতাকে অনুমোদন দিয়েছেন, কিন্তু অর্থহীনতাকে দেননি। বরং রবীন্দ্রনাথ তাঁর এ বক্তব্যে অতি স্পষ্টতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ওয়াহিদুল হক বলেছেন, 'কবি শিল্পীই বটেন। কিন্তু ছবি-গানে রূপটাই প্রায় সব, শেষ পর্যন্ত যেন রূপটাই সব। কবি রূপ গড়েন ভাষা দিয়ে, যে ভাষা ভরে থাকে মানুষের সব আপন-কথা দিয়ে, মানুষে-প্রকৃতিতে সব একে-অপরে আনাগোনার কথার প্রতীকীকৃত চিন্ময় অভিজ্ঞতা দিয়ে। কিংবা বুঝি রূপকে সহায় করে কবি অন্য কিছু গড়তে চান, বলতে চান যা বিজ্ঞানের চেয়ে মানবকেন্দ্রিক এবং অন্য সব শিল্পের চেয়েও অনেক বেশি করে কেবল মানুষেরই কথা, মানুষেরই সত্য। এসব বিচারে আমরা দেখি বিস্মরণের পাতা কবিতায় কবি কী বলেন_
এ পাতাটিকে কী আর বৃক্ষে ফেরানো যাবে না?/আশান্বিত ডালে এ পাতাটা কি/আবার শাখার বাঁকে বসে/আমাদের প্রতিপলের আলাপচারিতা দেখবে না?/এ কবিতায় অস্পষ্টতা নেই, অর্থহীন তো নয়ই।
কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, 'ধ ঢ়ড়বস নবমরহং রহ ফবষরমযঃ ধহফ বহফং রহ রিংফড়স'. খাটি কথা। মুরশেদ এখানে সফল। তাঁর 'রৌদ্রের খামে ভরা কথা' কবিতাটি দেখুন_
আমাদের কিছু কথা রৌদ্রের খামে ভরে প্রজাপতি করে দিই।/ওরা উড়ে উড়ে জাদুকরি রাত আনুক কাশের নগরে।/আমাদের কিছু কথা পাশে রেখে, কিছু কথা জাদুঘরে রেখে দিই।
কিছু কথা হয়ে যাক ধানবীজ তিল তিসি যবের দানা জমির পরানে।
পড়লে মনে হবে যেন জীবনানন্দ দাশের কাছ থেকে ধার করা। কবি এ লাইন ধার করেননি। সচেতনভাবে জীবনানন্দনীয় ভাবকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেননি_এই মাত্র। কারণ তাঁর অন্য কবিতাগুলোর কোথাও জীবনানন্দের কবিতার অনুকরণ লক্ষ করা যায় না।
মুজতবা আহমেদ মুরশেদের কবিতা নিয়ে কেন লিখতে গেলাম তার একটি কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি। আধুনিক কবিতা মানে শব্দের কাঠিন্য নয়। আমাদের চারপাশের পরিবেশ, জীবজগৎ ও সমাজ-মনস্তত্ত্বকে সাবলীল উপস্থাপনের দায়িত্ব একজন শক্তিশালী কবিকেই নিতে হয়। মুজতবা সে কাজটি করে যেতে চেষ্টায় আছেন। যথার্থই ঘোরে থাকেন বলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লিখছেন, লিখতে পারছেন। তাঁর গল্প, কবিতা, কিশোর সাহিত্য, নিবন্ধ, প্রবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে দেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকায়। সেসব রচনার পাঠও পাঠককে আনন্দ দেবে বুনো বাতাসের ঘ্রাণের মতোই।

-মহসীন হাবিব

গেরিলা যুদ্ধে নারীর অবদান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে : সেলিনা হোসেন

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্য যাদের হাতে পরিপুষ্ট হয়েছে সেলিনা হোসেন তাঁদের অন্যতম। ইতিহাসকে সমকালীন ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করে কথাসাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন তিনি। গত ১৪ জুন তার জন্মদিনে এ কথাশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কবি-কথাশিল্পী
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ


মুজতবা আহমেদ মুরশেদ : সেলিনা আপা, জীবনের এতগুলো বছর পার করে ৬৪তম জন্মদিনের ক্ষণে প্রথমেই আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
সেলিনা হোসেন : এককথায় বলি, কোনো অনুভূতিই নেই। কারণ জন্মদিন নিয়ে ভাবার অবকাশই নেই এবং সেভাবে কখনও আমার জন্মদিন পালিতও হয়নি।
মুরশেদ : উৎসবে রঙিন কোনো জন্মদিন পালনের ইচ্ছা কি জাগে না কখনও?
সেলিনা : রঙিন কোনো জন্মদিন পালনের ইচ্ছা জাগেনি কখনও আমার। কেউ তেমনভাবে পালনও করেনি। অবশ্য চ্যানেল আই একবার বেশ আয়োজন করে আমার জন্মদিন পালন করেছিল।
মুরশেদ : যা-ই হোক আপনার জন্মদিনের ক্ষণে শুভেচ্ছা জানাতে চাই প্রথমে। আমি মনে করি, সৃজনশীল মানুষের জন্মদিন বিশেষ অর্থ বহন করে। কারণ এই দিনে জন্মগ্রহণের মধ্য দিয়ে তার সৃজনশীলতার যাত্রা শুরু হয়। জন্মদিনের ক্ষণে আপনার শৈশবকে কি মনে পড়ে?
সেলিনা : আমার একটি সোনালি শৈশব আছে। আমি অসংখ্যবার বলেছি_ এই সোনালি শৈশব না থাকলে আমি কখনোই লেখক হতে পারতাম না।
মুরশেদ : সেই শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই।
সেলিনা : আমার শৈশবে আমি দুটি জিনিস বেশ উপভোগ করেছি_ অবাধ প্রকৃতি ও স্বাধীনতার সুখ। বাবার চাকরিসূত্রে বগুড়া জেলার করতোয়া নদীর পাড় ঘেঁষে থাকতাম আমরা। নদী ও এর চারপাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি আমি। নারীদের বর্তমান অবস্থানের তুলনায় আমার অবাধ স্বাধীনতা ছিল তখন। নদীর ঘাট, মাঠ, প্রান্তর, গাছে চড়া, মাছ ধরা_ এসব কিছুই করতাম ইচ্ছেমতো। ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো বাধাই ছিল না আমার।
মুরশেদ : তাহলে তো লম্বা সময় বলা যায়...
সেলিনা : হ্যাঁ, লম্বা সময়ই বলব। পরিবার, সমাজ_ চারপাশ থেকে কেউ কিছু বলত না। শৈশবে যে গ্রামটিতে থাকতাম, চারপাশে অনেক দরিদ্র মানুষজন ছিল। আমার বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার কারণে সমাজে আলাদা মর্যাদা পেতেন। গ্রামের সেই অসহায় লোকজন বাবার কাছে এসে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলত। বাবা এই মানুষদের সুবিধার কথা ভেবে হোমিওপ্যাথি চর্চা শুরু করলেন। আমি বাবার পাশে বসে পুরিয়া বানাতাম। তো সেই লোকগুলো অনেক গল্প বলত। বাবার পাশে বসে সেই গল্পগুলো শুনতাম। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর যখন ভাবছি কিছু লিখব, সেই গল্পগুলো মনে পড়ল। নারী-পুরুষ সম্পর্ক, মানুষের মনোস্তাত্তি্বক দ্বন্দ্বসহ আরও অনেক কিছুর অভিজ্ঞতাই কাজে লাগল। মোটকথা শৈশবের স্মৃতি না থাকলে হয়তো আমার লেখা অন্যরকম হতো, হয়তো বা হতোই না।
মুরশেদ : আপনার ছোটবেলার স্মৃতিচারণে পড়েছি, ছোটবোনের অসুখের জন্য ধানপাতা থেকে ভোরের শিশির সংগ্রহ করেছেন। এটি
বেদনার অভিজ্ঞতা হলেও অসাধারণ লেগেছে আমার কাছে।
সেলিনা : আমার ছোটবোন লাকী, চার বছর বয়সে নেফ্রাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিল। সে সময় তেমন কোনো চিকিৎসা ছিল না। বাবার হোমিওপ্যাথি আর গ্রামের কবিরাজই ছিল ভরসা। তখন গ্রামের একজন কবিরাজ তাকে শিশির খাওয়ানোর কথা বললেন। ভোর হতেই বাটি নিয়ে ছুটতাম শিশির সংগ্রহের জন্য। আমার মা কাপড়ে ছেঁকে সেই শিশির খাওয়াতেন ছোট বোনকে। সেই সব স্মৃতি এখনও অনেক তাজা। চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পাই।
মুরশেদ : এবার আপনার সাহিত্য প্রসঙ্গে আসি। এই সময়ে পেঁৗছে নিজের সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সেলিনা : নিজের সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করার সময় কি হয়েছে? সময়ই মূল্যায়ন করবে আমার কাজের। যারা পাঠক তারা মূল্যায়ন করবেন। আমি কাজ করে আনন্দ পাই। নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালনের চেষ্টা করি। গভীরভাবে ভেবে কাজটি করি। এসব নিয়ে আমার নিজের কোনো মূল্যায়ন নেই এখনও। ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান আমার 'গায়ত্রী সন্ধ্যা' উপন্যাসটির মূল্যায়ন করেছে। ১৬ বছর আগে লেখা উপন্যাস এখন এসে মূল্যায়িত হচ্ছে। আমার মনে হয়, দীর্ঘ সময় পাড়ি না দেওয়া পর্যন্ত কোনো সাহিত্যের মূল্যায়ন করা যায় না।
মুরশেদ : ৫০ ও ৬০-এর দশকে আমাদের গদ্য সাহিত্যে সমাজ ও ধর্মের অসঙ্গতিগুলো স্থান পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধও সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। আপনি ৬০-এর প্রজন্মের লেখক। মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব আপনার সাহিত্যে কেমনভাবে এসেছে?
সেলিনা : আমি লেখালেখি শুরু করি মূলত ৬০-এর মাঝামাঝি থেকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। সেভাবে প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়ার সুযোগও ঘটেনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অনক বিষয়ই নানাভাবে আমার উপন্যাসে উঠে এসেছে। যেমন_ 'হাঙর নদী গ্রেনেড'-এ মুক্তিযুদ্ধ এসেছে একভাবে, 'যুদ্ধ' উপন্যাসে এসেছে অন্যভাবে, আবার 'গায়ত্রী সন্ধ্যা'য় '৪৭ থেকে '৭৫ পর্যন্ত এসেছে। এখানে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক গেরিলা যুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে। গেরিলা যুদ্ধে নারীদের অবদান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে আমার। কীভাবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন_ এসব আর কি। আমি সব সময় চেষ্টা করি মুক্তিযুদ্ধের সব ধরনের সম্ভাব্যতাকে কাজে লাগাতে। মুক্তিযুদ্ধকে একরৈখিকভাবে না দেখে বহুরৈখিকভাবে উপস্থাপন করা দরকার। বহুরৈখিক উপস্থাপনার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে।
মুরশেদ : তাহলে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধকে সাহিত্যের উপাদান করে তোলা ওই প্রজন্মের সাহিত্যিকদের দায়বদ্ধতার অংশ?
সেলিনা : তা তো অবশ্যই।
মুরশেদ : আপনার শৈশব থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ_সব মিলিয়ে আপনার সাহিত্যে এক ধরনের মেলবন্ধন ঘটেছে_ এটা আমরা কি বলতে পারি?
সেলিনা : হ্যাঁ, এভাবে তো বলাই যায়। আগে আমি এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবার অবকাশ পাইনি। আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে ভিন্নভাবে আমার সাহিত্যকর্মের ওপর আলোকপাত করার জন্য।
মুরশেদ : প্রকৃতি কি আপনার লেখায় কখনও কখনও চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, চরিত্র হয়ে এসেছে?
সেলিনা : বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালী'র মতো প্রকৃতি আমার লেখায় তেমনভাবে চরিত্র হয়ে ওঠেনি। তবে একটি চরিত্রের সঙ্গে প্রকৃতি কিন্তু মিশে যায়। তার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে, তার জীবনযাপনের সঙ্গে প্রকৃতির এক ধরনের অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়।
মুরশেদ : শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনি কোন দিকটির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন? শব্দের ঘ্রাণ, নাকি শব্দের শক্তি?
সেলিনা : শব্দ নির্বাচনে শব্দের ঘ্রাণের চেয়ে শব্দের শক্তির দিকটি আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। লেখাকে মাত্রা দেওয়ার ক্ষেত্রে শব্দের শক্তি অনেক বেশি কার্যকর।
মুরশেদ : যখন একটি বিষয় নির্বাচন করেন কতটা সময় দেন, আপনার ভাবনার যে ঘর আছে, যে ঘোর আছে সেখানে_ বিষয়টি নিয়ে ভাবার ক্ষেত্রে?
সেলিনা : এ বছর একুশে বইমেলায় মির্জা গালিবের জীবনী উপজীব্য করে আমার যে উপন্যাস প্রকাশিত হলো, ১৯৮০ সাল থেকে এ উপন্যাস লেখার চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছি। গালিবের শের, তার জীবনী পড়ার পর আমার মনে হয়েছিল, এ নিয়ে একটি উপন্যাস হতে পারে। আমি তখনও জানতাম না কীভাবে লিখব। কারণ গালিবের জন্ম ভিনদেশে, বেড়ে উঠেছিলেন ভিন্ন পরিবেশে। এরপর '৯৬ সালে আমি আগ্রায় যাই, চাঁদনী চকসহ বেশকিছু জায়গা ভ্রমণ করি। ২০০ বছর পরের এসব স্থান কিন্তু আগের মতো ছিল না, এর পরও জায়গার ঘ্রাণ আমি অনুভব করেছি। পরবর্তী সময়ে গালিবের ওপর গবেষণার কাজ শুরু করি। বই পড়তে লাগলাম, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নোট করে রেখে দিতাম। এর মাঝে আমি অন্য অনেক কাজ কিন্তু করেছি। সবশেষে ২০০৮ সালে প্রথম লেখা শুরু করি এবং ২০১০-এ শেষ করি।
মুরশেদ : তাহলে একটি বিষয়বস্তু আপনার কাছে যতটুকু সময় দাবি করছে, আপনি ততটুকু সময় দিচ্ছেন...
সেলিনা : তা তো অবশ্যই দিতে হয়। প্রতিটি লেখকই তা দেন।
মুরশেদ : আমাদের অগ্রজ সাহিত্যিকদের মধ্যে আপনাকেই বেশি দেখা যায় ইতিহাসনির্ভর সাহিত্য রচনায়।
সেলিনা : আমি এই ধারাকে ইতিহাসনির্ভর না বলে বরং বলব_ আমি ইতিহাসের নবায়ন করি।
মুরশেদ : কিন্তু এর মাঝে ইতিহাসের উপাদান তো থাকে...
সেলিনা : ইতিহাসের উপাদান থাকলেও তা আমি সমকালীন করে ব্যবহার করি। রবীন্দ্রনাথের পতিসরে অবস্থানের সময় নিয়ে লিখেছি 'পূর্ণ ছবির মগ্নতা'। সেখানে লেখা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য চরিত্রকে নতুনভাবে তৈরি করেছি। আমি শুধু নিয়েছি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সময়কে। তাহলে আপনি কীভাবে বলবেন এই উপন্যাস ইতিহাসনির্ভর? রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন_ 'কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি/কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক/মেঘলা দিনে দেখেছিলাম মাঠে/কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ'। এই বেণী দুলিয়ে ছুটে যাওয়া মেয়ের মাঝে আমি আমার শৈশব খুঁজে পাই। মেয়েদের গায়ের কালো রঙ আমাদের সমাজে ভালোভাবে মূল্যায়িত হয় না। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, 'কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক'_ এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজের শ্রেণীবৈষম্য ও বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। এই কবিতাকে উপজীব্য করে আমি যে গল্প লিখেছি তার মাঝে দেখা যায়, মেয়ের বাবা জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছেন মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন নিয়ে। তিনি তখন একজনকে চিঠি লিখে দেন মেয়েটির বিয়ের জন্য। রবীন্দ্রনাথের কথায় মেয়েটির বিয়ে হয় সত্য কিন্তু যে ছেলেটির সঙ্গে তার বিয়ে হয়, সে ছেলেটি কালো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কারণে অভিমানে সে রাতেই আত্মহত্যা করে। কারণ এই বিয়েতে তার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। সমাজে সমাজপতিদের অধিকার ও ক্ষমতার বিষয়টি উঠে এসেছে এর মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে বাবা তার মেয়েটিকে নিয়ে জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে উপস্থিত হলে তিনি বলেন, 'তুমি দুঃখ কোরোনা, আমি আবার ওর বিয়ে দিব।' মেয়ের বাবা জমিদারের দিকে আঙুল তুলে বলেন_ 'বিধবার বিয়ে হয় না কখনো।' এখানে এই দরিদ্র লোকটি জমিদারের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, কারণ সে একজন বিধবার বাবা। এই সমসাময়িক সামাজিক চিত্রগুলো যখন উঠে আসে তখন কীভাবে সেটিকে ইতিহাসনির্ভরতা বলবেন আপনি?
অনেকেই আমার এই কাজগুলো নিয়ে বলেন, ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রয়োজনীয়তা কী? কিন্তু আমি সেই সময়কে কনটেম্পরারি করে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। গালিবকে নিয়ে উপন্যাসে শুধু গালিবের জীবনী ব্যবহার করেছি। বাকিটুকু আমার কল্পনার মিশেল দিয়ে এই সময়ের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছি। আমার একজন পাঠক এই উপন্যাস পড়ে জানালেন, এখানে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ নির্যাতনের চিত্রের সঙ্গে একাত্তরের মিল খুঁজে পেয়েছেন। আমি তো এই দিকটা খেয়াল করিনি। যখন আপনি আপনার দিকটা লেখার মধ্যে খুঁজে পাবেন তখন কোন ভিত্তিতে আপনি বলবেন এটা ঐতিহাসিক উপন্যাস?
মুরশেদ : আপনার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি একমত। আজ আমাদের আলোচনার মাধ্যমে আপনি নিজের লেখা সম্পর্কে যে যুক্তি দিলেন তার রেশ ধরে এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি_ ইতিহাসের উপাদান নিয়ে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে আপনি শক্তি বোধ করেন কোথা থেকে?
সেলিনা : আমি আমার পাঠকের কথা মাথায় রেখে ইতিহাসের উপাদান নিয়ে লেখার প্রেরণা বোধ করি। কারণ আমি লিখি পাঠকের জন্য। আমি যদি শুধু আমার জীবন অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখি, পাঠক তা কতক্ষণ গ্রহণ করবেন? বিষয়বৈচিত্র্যের কথা চিন্তা করে আমি ইতিহাসের উপাদান নিয়ে লিখি। যেমন_ ছিটমহল নিয়ে 'ভূমি ও কুসুম' উপন্যাসে আমি দেখাতে চেয়েছি রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দিকটি। ছিটমহল নিয়ে আমাদের এখানে কোনো উপন্যাস হয়নি, এমনকি আমার জানামতে পশ্চিমবঙ্গেও হয়নি। বিষয়বৈচিত্র্যের কারণেই ছিটমহলে জীবনযাপন নিয়ে এই উপন্যাসের আবির্ভাব।
মুরশেদ : আপনি একজন নারী। নিজের লেখায় কোনো শক্তিশালী নারী চরিত্র কি নির্মাণ করতে পেরেছেন আপনি?
সেলিনা : অবশ্যই সমাজে নারীদের অবস্থান আমাকে ভাবায়। এ তো সমাজ বাস্তবতা। আমি তো সমাজের বাইরে অবস্থান করি না। সেহেতু নারী প্রাসঙ্গিকভাবেই আমার লেখায় আসে। 'হাঙর নদী গ্রেনেড' উপন্যাসে দেখা যায়, একজন মা তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেন দু'জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য। এই মহিলা যে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন এটা তার শক্তি। কারণ তার ছেলে যুদ্ধে যেতে পারছে না_ এই দুঃখবোধের পাশাপাশি দু'জন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ার ভয়, হানাদার বাহিনীর নির্যাতন_ সব মিলিয়ে এই মহিলা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি মনে করি, নারীর ক্ষমতায়নের চিন্তা করলে এ ব্যাপারগুলো স্বাভাবিকভাবেই ফুটে ওঠে। কারণ জীবনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে নারী।
মুরশেদ : নারীকে কি আপনি ধরিত্রী হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন?
সেলিনা : নারীকে সেভাবে ধরিত্রী হিসেবে দেখাতে চাই না। প্রাকৃতিক কারণে নারী সন্তান ধারণ করে বলে তাকে আমি সব সময় 'মা' করে রাখব কেন? সে তো রাষ্ট্র ব্যবস্থারই অংশ। তার জন্য সব কাজের সুযোগ অবারিত করা উচিত। প্রয়োজন অনুযায়ী সে সব করবে_ সন্তান পালন, রান্নাবান্না, কৃষিকাজ, শুশ্রূষা এমনকি যুদ্ধও পর্যন্ত। আগামীতে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হবে, তবে দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতি ভেঙে নতুন করে শুরু করার জন্য সময়ও লাগবে।
মুরশেদ : শিল্পীদের সামাজিক দায়িত্বরোধ আছে। তারা সমাজকর্মীও বটে। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজ যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আপনি এটাকে কীভাবে দেখছেন? যেমন_ ডিভোর্স হচ্ছে অনেক বেশি, লিভ টুগেদারের চিন্তা হচ্ছে, নারীরা স্বাধীনতা চাইছে_ এ ব্যাপারগুলো...
সেলিনা : যারা নতুন পরিবর্তন চায় তাদের সংখ্যা কত? আমার দেশের চরের মেয়েরা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় পরিবর্তনকামীদের আনুপাতিক সংখ্যা নগণ্য। নিজের সংসার ধরে রাখার জন্য নারীদের চেষ্টা থাকে আপ্রাণ, শত নির্যাতন তারা সহ্য করে। আমার পরিচিত অনেক মেয়ের কথা জানি, যারা নিজের ঘর সামলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবুও পরিবর্তন তো স্বাভাবিক নিয়মেই আসবে।
মুরশেদ : সমাজের এই পরিবর্তনগুলো কি আপনার আগামী দিনের লেখায় আসবে?
সেলিনা : আমি চেষ্টা করছি। আমার যাপিত দিনের অভিজ্ঞতাগুলোর ভিতর দিয়ে সামাজিক পরিবর্তনকে ছুঁয়ে দেখার। আগামী দিনের লেখায় হয়তো এই চেষ্টা আরও বড় করে থাকবে। তবে এর মাঝে ু কিছু লেখা লিখেছিও, যেমন_ 'ঘর' গল্পটি।
মুরশেদ : সেলিনা আপা, দীর্ঘ লেখকজীবনে অসংখ্য চরিত্রের জন্ম হয়েছে

ষ এর পর ২৬ পৃষ্ঠায়
ষ ১৫ এর পৃষ্ঠার পর

আপনার হাত দিয়ে। এমন কোনো চরিত্র কি আছে যা এখনও আপনাকে চমকে দেয়, ফিরে তাকাতে বাধ্য করে?
সেলিনা : আমার প্রিয় কিছু চরিত্র আছে। যেমন_ 'গায়ত্রী সন্ধ্যা'য় মঞ্জুলিকা চরিত্রটি। 'ভূমি ও কুসুম' উপন্যাসের একটি চরিত্র, নাম মনে করতে পারছি না এই মুহূর্তে, এছাড়া 'আণবিক আঁধার' উপন্যাসে প্রশান্তি চরিত্রটি আমার প্রিয়। আমার প্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা জিজ্ঞাসা আছে, উপন্যাসগুলোতে তারা হয়তো খুব বড় চরিত্র নয়, কিন্তু তারা বড় চরিত্রগুলোর পাশাপাশিই হাঁটে।
মুরশেদ : এমন কোনো চরিত্র কি আছে যাদের প্রতি আক্ষেপ বোধ করেন যে, ঠিকভাবে নির্মাণ করতে পারেননি?
সেলিনা : এমন কিছু চরিত্র তো থাকেই। কখনও মনে হয়, বুঝি আরেকটু সময় পেলে হতো, আবার কখনও মনে হয়_ আর কীই বা করতে পারতাম এই চরিত্র নিয়ে? তবে কয়েকটি চরিত্র নিয়ে আবার কাজ করার ইচ্ছা আমার আছে। এমনকি মাঝেমধ্যে ভাবি, কিছু উপন্যাসও আবার নতুন করে লিখব।
মুরশেদ : বিশ্বসাহিত্য প্রসঙ্গে আসি এবার। বিশ্বের উন্নত সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের পার্থক্য কোন জায়গায় বলে আপনার ধারণা?
সেলিনা : বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের মৌলিক পার্থক্য অনুবাদে। আমাদের সাহিত্যের জীবনবোধের গভীরতা, উপলব্ধি তাদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। আমি কিছুদিন আগে আমেরিকা প্রবাসী থাইল্যান্ডের এক লেখকের বই পড়েছি, বেস্ট সেলার বই। পড়ে আমি হতাশ হয়েছি, কারণ ভাষা খুব জোলো। আমি মনে করি, অনুবাদ ভালো হয় না বলে আমাদের সাহিত্য বাইরে সেভাবে পরিচিতি পায় না।
মুরশেদ : সম্প্রতি ইতালিয়ান ভাষায় আপনার গল্প অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া ইংরেজিসহ ভারতীয় বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
সেলিনা : অন্য ভাষায় নিজের লেখা অনুবাদের বিষয়ে আমি কোনো পদক্ষেপই নিইনি কখনও। ইন্টারনেট থেকে পড়ে যারা আগ্রহী হয় তারা যোগাযোগ করে। এখানে কাউকে মানা তো করতে পারি না।
মুরশেদ : আপনার পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে বলুন?
সেলিনা : আমার পরবর্তী প্রজন্মে যারা লিখছে তারা ভালো করছে। নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকে ঝুঁকছে তারা। আমি আশাবাদী_ তারা তাদের সময়কে তুলে আনতে পারছে।
মুরশেদ : আগামী দিনে যারা লিখবে বলে ভাবছে তাদের প্রতি আপনি কী বলবেন?
সেলিনা : তেমন কিছু বলার নেই। তিনটি বিষয়ের প্রতি আমি জোর দিতে বলব_ ১. গভীর পর্যবেক্ষণশক্তি থাকতে হবে। ২. কঠিন পরিশ্রম করার ইচ্ছা থাকতে হবে ৩. সেই সঙ্গে প্রচুর পড়তে হবে। শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, এর বাইরে জ্ঞানের অন্যান্য দিক নিয়েও পড়াটা জরুরি।
মুরশেদ : সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের লেখক সত্তার জন্য কোনো প্রার্থনা করেন বা করেছেন কখনও?
সেলিনা : আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তবে সেভাবে হয়তো ধর্মীয় আচার পালন করা হয় না। অনেক প্রার্থনাই করেছি ঈশ্বরের কাছে। কিন্তু আমার লেখক সত্তার জন্য কখনও প্রার্থনা করিনি। কারণ আমি কাজে বিশ্বাস করি। পরিশ্রমে বিশ্বাস করি। আমার কাজই আমাকে সাহায্য করবে। নিজের সঙ্গে লড়াই করে যেতে হবে। কারণ ঈশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছেন।
মুরশেদ : আমরা একেবারেই শেষে চলে এসেছি। আবার জন্মদিন প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আপনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে অসংখ্য শুভেচ্ছা। যেন আরও অনেক দিন লিখে যেতে পারেন এই কামনা করছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিনা : আপনাকেও ধন্যবাদ।

শ্রুতি উদ্ধার :আহ্মাদ শামীম

প্রথম লেখার গল্প


প্রথম লেখার স্মৃতিটা বেশ পেছনের। তবে এতটা বয়স এখনও পার হইনি যে সেটাকে এক মহা ধূসর স্তরের কোন ঘটনা বলে মনে হবে। এখন থেকে হিসেব করলে সাঁইত্রিশ বছর আগের ঘটনা। ১৯৭৪ সাল। আমি জটিল এক রোগে আক্রান্ত হয়ে আবার অষ্টম শ্রেণীতেই। বিছানায় কাটলো ছ’মাস। তারপর সুস্থ হয়ে হাঁটাচলা। রোদে ঘোরাঘুরি বারণ। এইসবের মাঝেই বিছানায় শুয়ে আমার সাহিত্যগুরু বুবু’র (মরহুম সালমা ইয়াসমীন) জোগাড়ে থাকা উপন্যাস আর কাব্য পড়ি। তার সঙ্গে ওর লেখা কবিতা। ওর কবিতাগুলো আমার খুব ভাল লাগতো। অন্য একটা গন্ধ পেতাম। ওর প্রতি আমার অগাধ টান এবং ওর কবিতার প্রতি আমার আকর্ষণের ভেতরেই নিজের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা লেখার বীজটার নড়াচড়া অনুভব করলাম।

বুবু’র লেখা কবিতা পড়ি আর কেবলি মনে হয়, আমিও যদি বুবু’র মতো লিখতে পারতাম! কিন্তু মাথা চটকেও তো লেখা আসে না! এই ভাবনার ঘোরে আমি যখন অস্থির, তখন একদিন দুপুরে ভাত খেতে গিয়ে তরকারির বদলে শুধুই পাতলা ডাল আর কাঁচা মরিচের দেখা। মন খারাপ করে হাত গুটিয়ে বসে আছি। সামনে আম্মা আর বুবু। বুবু শান্তভাবে আমাকে বোঝাতে চাইলো। রাতে হয়তো অন্য তরকারি পাওয়া যেতে পারে। আম্মার (সমিদা বেগম) চোখে পানি। আমি বিমর্ষভাবে ভাত মুখে তুললাম। মরিচ খাবার অভ্যেস নেই। ভীষণ কষ্ট। ঝালে মুখ জ্বলেই যাচ্ছে। তারপরও আম্মার চোখের পানি আর দেশের জন্য সব বিলানো আব্বার অসহায় মুখটা ভেসে ওঠায় ওদের অপমান করতে চাইনি। ওভাবেই ভাতটুকু সাবাড় করলাম।
পেটে আর মুখে জ্বলুনি নিয়েই দোতলায় আমার শোবার ঘরে চলে গেলাম। বুবু আমি এক বিছানায়ই থাকতাম। ঘরে গিয়ে দেখি বুবু আগে থেকেই বিছানায় বসা। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে একটা বই ধরিয়ে দিল। ‘পড়িস। রাতে এটা নিয়ে গল্প করবো।’ এ কথা বলেই ঘর ছেড়ে চলে গেল।

বইটা হাতে আমি ঘরের উঁচু সিলিংয়ের দিকে স্থির তাকিয়ে। দেশজুড়েই দুর্ভিক্ষ। বিস্ময়করভাবে আমাদের বাড়িতেও সেটা হানা দিয়েছে। অন্য অনেকের সঙ্গে আমাদের তফাৎ এই, আমরা অন্তত নানা কিছুর জোড়াতালি দিয়ে দু’বেলা কিছু খেতে পাই। অথচ এটা আমাদের জীবন নয়। হওয়ার কথাও ছিল না। বইটা হাতেই আব্বার কথা মনে পড়ছে। আব্বার (মরহুম মো. আজিজুর রহমান) নেতৃত্বে রাজনীতি করা দিনাজপুর জেলার গুটিকয় নেতার অনৈতিক খল-ষড়যন্ত্র আব্বাকে ১৯৭৩ সালে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তাকে নির্বাচনী টিকিট দেয়া হয়নি। আত্মমর্যাদায় আঘাত নিয়ে আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও উনি আদালতে ফিরতে পারছিলেন না। ১৯৬৬ সাল থেকে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা সভাপতি, ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় উনি ৭নং সেক্টরের সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার ছিলেন। এসব নিয়ে একদা দিনাজপুর জেলায় প্রটোকলে প্রথম অবস্থানে থাকা মানুষটি কোনভাবেই আদালতে ফিরে গিয়ে জজ সাহেবদের সামনে মাথা নোয়াতে পারছিলেন না। ফলে আমরা এক প্রবল অর্থ কষ্টের গর্তে পড়ে আছি। এদিকে সেই পাকিস্তান আমল থেকে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে আওয়ামী লীগের ভিত্তি গড়তে আব্বার আইন পেশার অর্থ আর আবাদি জমি বিক্রিও শেষ। এই অবস্থায় আত্মীয়রাও আমাদের কাছে ভিড়ে না। এ যেন ছিল, ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা ! জীবনটা নাই কোথা। চারিদিকে মৃত্যুই প্রস্তুত !’

আব্বার এই প্রবল অসহায়ত্ব আমাকে মানসিকভাবে আঘাত করেছিল। সেই ক্ষোভের সঙ্গে সেদিনের দুপুর বেলায় কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খাওয়াটা আমার ভেতরে লেখার আকাঙ্ক্ষায় নড়তে থাকা বীজটার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। খুলে গেল আমার লেখার জ্বালামুখ।

সেই দিনটার তীব্রতা আমাকে আজও তাড়িয়ে ফিরে। তারিখটা মনে নেই। তবে সেটা গরম কাল তো হবেই। যে কবিতাটা লিখেছিলাম, সেটা সংগ্রহেও নেই। কবিতাটা ক’বার পড়ে বুবুকে পড়ে শোনালাম। আম্মাকেও। বুবু দারুণ কোন মন্তব্য করলো না। উৎসাহ দিল, ‘বাহ! শুরু তো হলো। লিখতেই থাক। থামিস না।’ বুঝলাম, আমি যা লিখতে চাই এ লেখা সে লেখা নয়। ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেল্লাম। তবে মনে আছে সেখানে প্রবল দ্রোহ ছিল।
আমার লেখক জীবনের সত্যিকারের পুনর্জন্ম ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। হঠাৎ করেই একটা কবিতা লেখলাম। আর কাকতালীয়ভাবে শুনলাম দিনাজপুর নওরোজ সাহিত্য সভা কবিতা পাঠের আয়োজন করেছে। দুরু দুরু বুকে হাজির। শহরের মাঝখানে হেমায়েত আলী হল। সেখানে অগ্রজ কবি, সাহিত্যিক জমায়েত। আমি কবিতা পাঠ করলাম। পাঠ শেষে জানলাম মানোতীর্ণ কবিতার কবিকে পুরস্কৃত করা হবে। আমি কবিতায় পেলাম দিনাজপুর নওরোজ সাহিত্যের দ্বিতীয় পুরস্কার। কবিতার চরণগুলি ছিল এ রকম-

‘বুক ভাঙা নিঃশ্বাস আহত বেদনা ছুড়ে ছুড়ে জমা হয় ডাস্টবিনে দিন প্রতিদিন।
একটি দিনের অসংখ্য মুহূর্ত এবং তোমার আমার চাওয়া পাওয়ার এক বিরাট ফর্দ
জমা হয় ডাস্টবিনে ধীরে অবাক ভঙ্গিতে!
এক।
দুই।
তিন।
তার সঙ্গে জমা হয় ঘটি বাটি কাঁথা খুলি বুলেটের খোল।
নোংরা জঞ্জালের এক বিরাট স্তূপ।
সবকিছু তুলে নিয়ে ঢেকে রাখে ডাস্টবিন বুকের ভেতর অজস্র মমতায়
এক মহাপুরুষ কোন।’

সেই হলো সত্যিকারের শুরু। লেখক জীবনের এক অভিযাত্রা। এখনও সেই পথেই হেঁটে চলেছি।

বৃহস্পতিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১১

ইউটিউবে

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites