বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১১

প্রথম লেখার গল্প


প্রথম লেখার স্মৃতিটা বেশ পেছনের। তবে এতটা বয়স এখনও পার হইনি যে সেটাকে এক মহা ধূসর স্তরের কোন ঘটনা বলে মনে হবে। এখন থেকে হিসেব করলে সাঁইত্রিশ বছর আগের ঘটনা। ১৯৭৪ সাল। আমি জটিল এক রোগে আক্রান্ত হয়ে আবার অষ্টম শ্রেণীতেই। বিছানায় কাটলো ছ’মাস। তারপর সুস্থ হয়ে হাঁটাচলা। রোদে ঘোরাঘুরি বারণ। এইসবের মাঝেই বিছানায় শুয়ে আমার সাহিত্যগুরু বুবু’র (মরহুম সালমা ইয়াসমীন) জোগাড়ে থাকা উপন্যাস আর কাব্য পড়ি। তার সঙ্গে ওর লেখা কবিতা। ওর কবিতাগুলো আমার খুব ভাল লাগতো। অন্য একটা গন্ধ পেতাম। ওর প্রতি আমার অগাধ টান এবং ওর কবিতার প্রতি আমার আকর্ষণের ভেতরেই নিজের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা লেখার বীজটার নড়াচড়া অনুভব করলাম।

বুবু’র লেখা কবিতা পড়ি আর কেবলি মনে হয়, আমিও যদি বুবু’র মতো লিখতে পারতাম! কিন্তু মাথা চটকেও তো লেখা আসে না! এই ভাবনার ঘোরে আমি যখন অস্থির, তখন একদিন দুপুরে ভাত খেতে গিয়ে তরকারির বদলে শুধুই পাতলা ডাল আর কাঁচা মরিচের দেখা। মন খারাপ করে হাত গুটিয়ে বসে আছি। সামনে আম্মা আর বুবু। বুবু শান্তভাবে আমাকে বোঝাতে চাইলো। রাতে হয়তো অন্য তরকারি পাওয়া যেতে পারে। আম্মার (সমিদা বেগম) চোখে পানি। আমি বিমর্ষভাবে ভাত মুখে তুললাম। মরিচ খাবার অভ্যেস নেই। ভীষণ কষ্ট। ঝালে মুখ জ্বলেই যাচ্ছে। তারপরও আম্মার চোখের পানি আর দেশের জন্য সব বিলানো আব্বার অসহায় মুখটা ভেসে ওঠায় ওদের অপমান করতে চাইনি। ওভাবেই ভাতটুকু সাবাড় করলাম।
পেটে আর মুখে জ্বলুনি নিয়েই দোতলায় আমার শোবার ঘরে চলে গেলাম। বুবু আমি এক বিছানায়ই থাকতাম। ঘরে গিয়ে দেখি বুবু আগে থেকেই বিছানায় বসা। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে একটা বই ধরিয়ে দিল। ‘পড়িস। রাতে এটা নিয়ে গল্প করবো।’ এ কথা বলেই ঘর ছেড়ে চলে গেল।

বইটা হাতে আমি ঘরের উঁচু সিলিংয়ের দিকে স্থির তাকিয়ে। দেশজুড়েই দুর্ভিক্ষ। বিস্ময়করভাবে আমাদের বাড়িতেও সেটা হানা দিয়েছে। অন্য অনেকের সঙ্গে আমাদের তফাৎ এই, আমরা অন্তত নানা কিছুর জোড়াতালি দিয়ে দু’বেলা কিছু খেতে পাই। অথচ এটা আমাদের জীবন নয়। হওয়ার কথাও ছিল না। বইটা হাতেই আব্বার কথা মনে পড়ছে। আব্বার (মরহুম মো. আজিজুর রহমান) নেতৃত্বে রাজনীতি করা দিনাজপুর জেলার গুটিকয় নেতার অনৈতিক খল-ষড়যন্ত্র আব্বাকে ১৯৭৩ সালে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তাকে নির্বাচনী টিকিট দেয়া হয়নি। আত্মমর্যাদায় আঘাত নিয়ে আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও উনি আদালতে ফিরতে পারছিলেন না। ১৯৬৬ সাল থেকে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা সভাপতি, ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় উনি ৭নং সেক্টরের সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার ছিলেন। এসব নিয়ে একদা দিনাজপুর জেলায় প্রটোকলে প্রথম অবস্থানে থাকা মানুষটি কোনভাবেই আদালতে ফিরে গিয়ে জজ সাহেবদের সামনে মাথা নোয়াতে পারছিলেন না। ফলে আমরা এক প্রবল অর্থ কষ্টের গর্তে পড়ে আছি। এদিকে সেই পাকিস্তান আমল থেকে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে আওয়ামী লীগের ভিত্তি গড়তে আব্বার আইন পেশার অর্থ আর আবাদি জমি বিক্রিও শেষ। এই অবস্থায় আত্মীয়রাও আমাদের কাছে ভিড়ে না। এ যেন ছিল, ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা ! জীবনটা নাই কোথা। চারিদিকে মৃত্যুই প্রস্তুত !’

আব্বার এই প্রবল অসহায়ত্ব আমাকে মানসিকভাবে আঘাত করেছিল। সেই ক্ষোভের সঙ্গে সেদিনের দুপুর বেলায় কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খাওয়াটা আমার ভেতরে লেখার আকাঙ্ক্ষায় নড়তে থাকা বীজটার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। খুলে গেল আমার লেখার জ্বালামুখ।

সেই দিনটার তীব্রতা আমাকে আজও তাড়িয়ে ফিরে। তারিখটা মনে নেই। তবে সেটা গরম কাল তো হবেই। যে কবিতাটা লিখেছিলাম, সেটা সংগ্রহেও নেই। কবিতাটা ক’বার পড়ে বুবুকে পড়ে শোনালাম। আম্মাকেও। বুবু দারুণ কোন মন্তব্য করলো না। উৎসাহ দিল, ‘বাহ! শুরু তো হলো। লিখতেই থাক। থামিস না।’ বুঝলাম, আমি যা লিখতে চাই এ লেখা সে লেখা নয়। ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেল্লাম। তবে মনে আছে সেখানে প্রবল দ্রোহ ছিল।
আমার লেখক জীবনের সত্যিকারের পুনর্জন্ম ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। হঠাৎ করেই একটা কবিতা লেখলাম। আর কাকতালীয়ভাবে শুনলাম দিনাজপুর নওরোজ সাহিত্য সভা কবিতা পাঠের আয়োজন করেছে। দুরু দুরু বুকে হাজির। শহরের মাঝখানে হেমায়েত আলী হল। সেখানে অগ্রজ কবি, সাহিত্যিক জমায়েত। আমি কবিতা পাঠ করলাম। পাঠ শেষে জানলাম মানোতীর্ণ কবিতার কবিকে পুরস্কৃত করা হবে। আমি কবিতায় পেলাম দিনাজপুর নওরোজ সাহিত্যের দ্বিতীয় পুরস্কার। কবিতার চরণগুলি ছিল এ রকম-

‘বুক ভাঙা নিঃশ্বাস আহত বেদনা ছুড়ে ছুড়ে জমা হয় ডাস্টবিনে দিন প্রতিদিন।
একটি দিনের অসংখ্য মুহূর্ত এবং তোমার আমার চাওয়া পাওয়ার এক বিরাট ফর্দ
জমা হয় ডাস্টবিনে ধীরে অবাক ভঙ্গিতে!
এক।
দুই।
তিন।
তার সঙ্গে জমা হয় ঘটি বাটি কাঁথা খুলি বুলেটের খোল।
নোংরা জঞ্জালের এক বিরাট স্তূপ।
সবকিছু তুলে নিয়ে ঢেকে রাখে ডাস্টবিন বুকের ভেতর অজস্র মমতায়
এক মহাপুরুষ কোন।’

সেই হলো সত্যিকারের শুরু। লেখক জীবনের এক অভিযাত্রা। এখনও সেই পথেই হেঁটে চলেছি।

বৃহস্পতিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১১

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites