বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১১

গেরিলা যুদ্ধে নারীর অবদান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে : সেলিনা হোসেন

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্য যাদের হাতে পরিপুষ্ট হয়েছে সেলিনা হোসেন তাঁদের অন্যতম। ইতিহাসকে সমকালীন ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করে কথাসাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন তিনি। গত ১৪ জুন তার জন্মদিনে এ কথাশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কবি-কথাশিল্পী
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ


মুজতবা আহমেদ মুরশেদ : সেলিনা আপা, জীবনের এতগুলো বছর পার করে ৬৪তম জন্মদিনের ক্ষণে প্রথমেই আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
সেলিনা হোসেন : এককথায় বলি, কোনো অনুভূতিই নেই। কারণ জন্মদিন নিয়ে ভাবার অবকাশই নেই এবং সেভাবে কখনও আমার জন্মদিন পালিতও হয়নি।
মুরশেদ : উৎসবে রঙিন কোনো জন্মদিন পালনের ইচ্ছা কি জাগে না কখনও?
সেলিনা : রঙিন কোনো জন্মদিন পালনের ইচ্ছা জাগেনি কখনও আমার। কেউ তেমনভাবে পালনও করেনি। অবশ্য চ্যানেল আই একবার বেশ আয়োজন করে আমার জন্মদিন পালন করেছিল।
মুরশেদ : যা-ই হোক আপনার জন্মদিনের ক্ষণে শুভেচ্ছা জানাতে চাই প্রথমে। আমি মনে করি, সৃজনশীল মানুষের জন্মদিন বিশেষ অর্থ বহন করে। কারণ এই দিনে জন্মগ্রহণের মধ্য দিয়ে তার সৃজনশীলতার যাত্রা শুরু হয়। জন্মদিনের ক্ষণে আপনার শৈশবকে কি মনে পড়ে?
সেলিনা : আমার একটি সোনালি শৈশব আছে। আমি অসংখ্যবার বলেছি_ এই সোনালি শৈশব না থাকলে আমি কখনোই লেখক হতে পারতাম না।
মুরশেদ : সেই শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই।
সেলিনা : আমার শৈশবে আমি দুটি জিনিস বেশ উপভোগ করেছি_ অবাধ প্রকৃতি ও স্বাধীনতার সুখ। বাবার চাকরিসূত্রে বগুড়া জেলার করতোয়া নদীর পাড় ঘেঁষে থাকতাম আমরা। নদী ও এর চারপাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি আমি। নারীদের বর্তমান অবস্থানের তুলনায় আমার অবাধ স্বাধীনতা ছিল তখন। নদীর ঘাট, মাঠ, প্রান্তর, গাছে চড়া, মাছ ধরা_ এসব কিছুই করতাম ইচ্ছেমতো। ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো বাধাই ছিল না আমার।
মুরশেদ : তাহলে তো লম্বা সময় বলা যায়...
সেলিনা : হ্যাঁ, লম্বা সময়ই বলব। পরিবার, সমাজ_ চারপাশ থেকে কেউ কিছু বলত না। শৈশবে যে গ্রামটিতে থাকতাম, চারপাশে অনেক দরিদ্র মানুষজন ছিল। আমার বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার কারণে সমাজে আলাদা মর্যাদা পেতেন। গ্রামের সেই অসহায় লোকজন বাবার কাছে এসে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলত। বাবা এই মানুষদের সুবিধার কথা ভেবে হোমিওপ্যাথি চর্চা শুরু করলেন। আমি বাবার পাশে বসে পুরিয়া বানাতাম। তো সেই লোকগুলো অনেক গল্প বলত। বাবার পাশে বসে সেই গল্পগুলো শুনতাম। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর যখন ভাবছি কিছু লিখব, সেই গল্পগুলো মনে পড়ল। নারী-পুরুষ সম্পর্ক, মানুষের মনোস্তাত্তি্বক দ্বন্দ্বসহ আরও অনেক কিছুর অভিজ্ঞতাই কাজে লাগল। মোটকথা শৈশবের স্মৃতি না থাকলে হয়তো আমার লেখা অন্যরকম হতো, হয়তো বা হতোই না।
মুরশেদ : আপনার ছোটবেলার স্মৃতিচারণে পড়েছি, ছোটবোনের অসুখের জন্য ধানপাতা থেকে ভোরের শিশির সংগ্রহ করেছেন। এটি
বেদনার অভিজ্ঞতা হলেও অসাধারণ লেগেছে আমার কাছে।
সেলিনা : আমার ছোটবোন লাকী, চার বছর বয়সে নেফ্রাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিল। সে সময় তেমন কোনো চিকিৎসা ছিল না। বাবার হোমিওপ্যাথি আর গ্রামের কবিরাজই ছিল ভরসা। তখন গ্রামের একজন কবিরাজ তাকে শিশির খাওয়ানোর কথা বললেন। ভোর হতেই বাটি নিয়ে ছুটতাম শিশির সংগ্রহের জন্য। আমার মা কাপড়ে ছেঁকে সেই শিশির খাওয়াতেন ছোট বোনকে। সেই সব স্মৃতি এখনও অনেক তাজা। চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পাই।
মুরশেদ : এবার আপনার সাহিত্য প্রসঙ্গে আসি। এই সময়ে পেঁৗছে নিজের সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সেলিনা : নিজের সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করার সময় কি হয়েছে? সময়ই মূল্যায়ন করবে আমার কাজের। যারা পাঠক তারা মূল্যায়ন করবেন। আমি কাজ করে আনন্দ পাই। নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালনের চেষ্টা করি। গভীরভাবে ভেবে কাজটি করি। এসব নিয়ে আমার নিজের কোনো মূল্যায়ন নেই এখনও। ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান আমার 'গায়ত্রী সন্ধ্যা' উপন্যাসটির মূল্যায়ন করেছে। ১৬ বছর আগে লেখা উপন্যাস এখন এসে মূল্যায়িত হচ্ছে। আমার মনে হয়, দীর্ঘ সময় পাড়ি না দেওয়া পর্যন্ত কোনো সাহিত্যের মূল্যায়ন করা যায় না।
মুরশেদ : ৫০ ও ৬০-এর দশকে আমাদের গদ্য সাহিত্যে সমাজ ও ধর্মের অসঙ্গতিগুলো স্থান পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধও সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। আপনি ৬০-এর প্রজন্মের লেখক। মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব আপনার সাহিত্যে কেমনভাবে এসেছে?
সেলিনা : আমি লেখালেখি শুরু করি মূলত ৬০-এর মাঝামাঝি থেকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। সেভাবে প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়ার সুযোগও ঘটেনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অনক বিষয়ই নানাভাবে আমার উপন্যাসে উঠে এসেছে। যেমন_ 'হাঙর নদী গ্রেনেড'-এ মুক্তিযুদ্ধ এসেছে একভাবে, 'যুদ্ধ' উপন্যাসে এসেছে অন্যভাবে, আবার 'গায়ত্রী সন্ধ্যা'য় '৪৭ থেকে '৭৫ পর্যন্ত এসেছে। এখানে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক গেরিলা যুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে। গেরিলা যুদ্ধে নারীদের অবদান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে আমার। কীভাবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন_ এসব আর কি। আমি সব সময় চেষ্টা করি মুক্তিযুদ্ধের সব ধরনের সম্ভাব্যতাকে কাজে লাগাতে। মুক্তিযুদ্ধকে একরৈখিকভাবে না দেখে বহুরৈখিকভাবে উপস্থাপন করা দরকার। বহুরৈখিক উপস্থাপনার মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে।
মুরশেদ : তাহলে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধকে সাহিত্যের উপাদান করে তোলা ওই প্রজন্মের সাহিত্যিকদের দায়বদ্ধতার অংশ?
সেলিনা : তা তো অবশ্যই।
মুরশেদ : আপনার শৈশব থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ_সব মিলিয়ে আপনার সাহিত্যে এক ধরনের মেলবন্ধন ঘটেছে_ এটা আমরা কি বলতে পারি?
সেলিনা : হ্যাঁ, এভাবে তো বলাই যায়। আগে আমি এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবার অবকাশ পাইনি। আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে ভিন্নভাবে আমার সাহিত্যকর্মের ওপর আলোকপাত করার জন্য।
মুরশেদ : প্রকৃতি কি আপনার লেখায় কখনও কখনও চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, চরিত্র হয়ে এসেছে?
সেলিনা : বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালী'র মতো প্রকৃতি আমার লেখায় তেমনভাবে চরিত্র হয়ে ওঠেনি। তবে একটি চরিত্রের সঙ্গে প্রকৃতি কিন্তু মিশে যায়। তার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে, তার জীবনযাপনের সঙ্গে প্রকৃতির এক ধরনের অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়।
মুরশেদ : শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনি কোন দিকটির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন? শব্দের ঘ্রাণ, নাকি শব্দের শক্তি?
সেলিনা : শব্দ নির্বাচনে শব্দের ঘ্রাণের চেয়ে শব্দের শক্তির দিকটি আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। লেখাকে মাত্রা দেওয়ার ক্ষেত্রে শব্দের শক্তি অনেক বেশি কার্যকর।
মুরশেদ : যখন একটি বিষয় নির্বাচন করেন কতটা সময় দেন, আপনার ভাবনার যে ঘর আছে, যে ঘোর আছে সেখানে_ বিষয়টি নিয়ে ভাবার ক্ষেত্রে?
সেলিনা : এ বছর একুশে বইমেলায় মির্জা গালিবের জীবনী উপজীব্য করে আমার যে উপন্যাস প্রকাশিত হলো, ১৯৮০ সাল থেকে এ উপন্যাস লেখার চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছি। গালিবের শের, তার জীবনী পড়ার পর আমার মনে হয়েছিল, এ নিয়ে একটি উপন্যাস হতে পারে। আমি তখনও জানতাম না কীভাবে লিখব। কারণ গালিবের জন্ম ভিনদেশে, বেড়ে উঠেছিলেন ভিন্ন পরিবেশে। এরপর '৯৬ সালে আমি আগ্রায় যাই, চাঁদনী চকসহ বেশকিছু জায়গা ভ্রমণ করি। ২০০ বছর পরের এসব স্থান কিন্তু আগের মতো ছিল না, এর পরও জায়গার ঘ্রাণ আমি অনুভব করেছি। পরবর্তী সময়ে গালিবের ওপর গবেষণার কাজ শুরু করি। বই পড়তে লাগলাম, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নোট করে রেখে দিতাম। এর মাঝে আমি অন্য অনেক কাজ কিন্তু করেছি। সবশেষে ২০০৮ সালে প্রথম লেখা শুরু করি এবং ২০১০-এ শেষ করি।
মুরশেদ : তাহলে একটি বিষয়বস্তু আপনার কাছে যতটুকু সময় দাবি করছে, আপনি ততটুকু সময় দিচ্ছেন...
সেলিনা : তা তো অবশ্যই দিতে হয়। প্রতিটি লেখকই তা দেন।
মুরশেদ : আমাদের অগ্রজ সাহিত্যিকদের মধ্যে আপনাকেই বেশি দেখা যায় ইতিহাসনির্ভর সাহিত্য রচনায়।
সেলিনা : আমি এই ধারাকে ইতিহাসনির্ভর না বলে বরং বলব_ আমি ইতিহাসের নবায়ন করি।
মুরশেদ : কিন্তু এর মাঝে ইতিহাসের উপাদান তো থাকে...
সেলিনা : ইতিহাসের উপাদান থাকলেও তা আমি সমকালীন করে ব্যবহার করি। রবীন্দ্রনাথের পতিসরে অবস্থানের সময় নিয়ে লিখেছি 'পূর্ণ ছবির মগ্নতা'। সেখানে লেখা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য চরিত্রকে নতুনভাবে তৈরি করেছি। আমি শুধু নিয়েছি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সময়কে। তাহলে আপনি কীভাবে বলবেন এই উপন্যাস ইতিহাসনির্ভর? রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন_ 'কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি/কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক/মেঘলা দিনে দেখেছিলাম মাঠে/কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ'। এই বেণী দুলিয়ে ছুটে যাওয়া মেয়ের মাঝে আমি আমার শৈশব খুঁজে পাই। মেয়েদের গায়ের কালো রঙ আমাদের সমাজে ভালোভাবে মূল্যায়িত হয় না। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, 'কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক'_ এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজের শ্রেণীবৈষম্য ও বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। এই কবিতাকে উপজীব্য করে আমি যে গল্প লিখেছি তার মাঝে দেখা যায়, মেয়ের বাবা জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছেন মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন নিয়ে। তিনি তখন একজনকে চিঠি লিখে দেন মেয়েটির বিয়ের জন্য। রবীন্দ্রনাথের কথায় মেয়েটির বিয়ে হয় সত্য কিন্তু যে ছেলেটির সঙ্গে তার বিয়ে হয়, সে ছেলেটি কালো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কারণে অভিমানে সে রাতেই আত্মহত্যা করে। কারণ এই বিয়েতে তার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। সমাজে সমাজপতিদের অধিকার ও ক্ষমতার বিষয়টি উঠে এসেছে এর মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে বাবা তার মেয়েটিকে নিয়ে জমিদার রবীন্দ্রনাথের কাছে উপস্থিত হলে তিনি বলেন, 'তুমি দুঃখ কোরোনা, আমি আবার ওর বিয়ে দিব।' মেয়ের বাবা জমিদারের দিকে আঙুল তুলে বলেন_ 'বিধবার বিয়ে হয় না কখনো।' এখানে এই দরিদ্র লোকটি জমিদারের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, কারণ সে একজন বিধবার বাবা। এই সমসাময়িক সামাজিক চিত্রগুলো যখন উঠে আসে তখন কীভাবে সেটিকে ইতিহাসনির্ভরতা বলবেন আপনি?
অনেকেই আমার এই কাজগুলো নিয়ে বলেন, ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রয়োজনীয়তা কী? কিন্তু আমি সেই সময়কে কনটেম্পরারি করে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। গালিবকে নিয়ে উপন্যাসে শুধু গালিবের জীবনী ব্যবহার করেছি। বাকিটুকু আমার কল্পনার মিশেল দিয়ে এই সময়ের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছি। আমার একজন পাঠক এই উপন্যাস পড়ে জানালেন, এখানে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ নির্যাতনের চিত্রের সঙ্গে একাত্তরের মিল খুঁজে পেয়েছেন। আমি তো এই দিকটা খেয়াল করিনি। যখন আপনি আপনার দিকটা লেখার মধ্যে খুঁজে পাবেন তখন কোন ভিত্তিতে আপনি বলবেন এটা ঐতিহাসিক উপন্যাস?
মুরশেদ : আপনার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি একমত। আজ আমাদের আলোচনার মাধ্যমে আপনি নিজের লেখা সম্পর্কে যে যুক্তি দিলেন তার রেশ ধরে এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি_ ইতিহাসের উপাদান নিয়ে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে আপনি শক্তি বোধ করেন কোথা থেকে?
সেলিনা : আমি আমার পাঠকের কথা মাথায় রেখে ইতিহাসের উপাদান নিয়ে লেখার প্রেরণা বোধ করি। কারণ আমি লিখি পাঠকের জন্য। আমি যদি শুধু আমার জীবন অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখি, পাঠক তা কতক্ষণ গ্রহণ করবেন? বিষয়বৈচিত্র্যের কথা চিন্তা করে আমি ইতিহাসের উপাদান নিয়ে লিখি। যেমন_ ছিটমহল নিয়ে 'ভূমি ও কুসুম' উপন্যাসে আমি দেখাতে চেয়েছি রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দিকটি। ছিটমহল নিয়ে আমাদের এখানে কোনো উপন্যাস হয়নি, এমনকি আমার জানামতে পশ্চিমবঙ্গেও হয়নি। বিষয়বৈচিত্র্যের কারণেই ছিটমহলে জীবনযাপন নিয়ে এই উপন্যাসের আবির্ভাব।
মুরশেদ : আপনি একজন নারী। নিজের লেখায় কোনো শক্তিশালী নারী চরিত্র কি নির্মাণ করতে পেরেছেন আপনি?
সেলিনা : অবশ্যই সমাজে নারীদের অবস্থান আমাকে ভাবায়। এ তো সমাজ বাস্তবতা। আমি তো সমাজের বাইরে অবস্থান করি না। সেহেতু নারী প্রাসঙ্গিকভাবেই আমার লেখায় আসে। 'হাঙর নদী গ্রেনেড' উপন্যাসে দেখা যায়, একজন মা তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেন দু'জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য। এই মহিলা যে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন এটা তার শক্তি। কারণ তার ছেলে যুদ্ধে যেতে পারছে না_ এই দুঃখবোধের পাশাপাশি দু'জন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ার ভয়, হানাদার বাহিনীর নির্যাতন_ সব মিলিয়ে এই মহিলা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি মনে করি, নারীর ক্ষমতায়নের চিন্তা করলে এ ব্যাপারগুলো স্বাভাবিকভাবেই ফুটে ওঠে। কারণ জীবনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে নারী।
মুরশেদ : নারীকে কি আপনি ধরিত্রী হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন?
সেলিনা : নারীকে সেভাবে ধরিত্রী হিসেবে দেখাতে চাই না। প্রাকৃতিক কারণে নারী সন্তান ধারণ করে বলে তাকে আমি সব সময় 'মা' করে রাখব কেন? সে তো রাষ্ট্র ব্যবস্থারই অংশ। তার জন্য সব কাজের সুযোগ অবারিত করা উচিত। প্রয়োজন অনুযায়ী সে সব করবে_ সন্তান পালন, রান্নাবান্না, কৃষিকাজ, শুশ্রূষা এমনকি যুদ্ধও পর্যন্ত। আগামীতে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হবে, তবে দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতি ভেঙে নতুন করে শুরু করার জন্য সময়ও লাগবে।
মুরশেদ : শিল্পীদের সামাজিক দায়িত্বরোধ আছে। তারা সমাজকর্মীও বটে। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজ যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আপনি এটাকে কীভাবে দেখছেন? যেমন_ ডিভোর্স হচ্ছে অনেক বেশি, লিভ টুগেদারের চিন্তা হচ্ছে, নারীরা স্বাধীনতা চাইছে_ এ ব্যাপারগুলো...
সেলিনা : যারা নতুন পরিবর্তন চায় তাদের সংখ্যা কত? আমার দেশের চরের মেয়েরা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় পরিবর্তনকামীদের আনুপাতিক সংখ্যা নগণ্য। নিজের সংসার ধরে রাখার জন্য নারীদের চেষ্টা থাকে আপ্রাণ, শত নির্যাতন তারা সহ্য করে। আমার পরিচিত অনেক মেয়ের কথা জানি, যারা নিজের ঘর সামলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবুও পরিবর্তন তো স্বাভাবিক নিয়মেই আসবে।
মুরশেদ : সমাজের এই পরিবর্তনগুলো কি আপনার আগামী দিনের লেখায় আসবে?
সেলিনা : আমি চেষ্টা করছি। আমার যাপিত দিনের অভিজ্ঞতাগুলোর ভিতর দিয়ে সামাজিক পরিবর্তনকে ছুঁয়ে দেখার। আগামী দিনের লেখায় হয়তো এই চেষ্টা আরও বড় করে থাকবে। তবে এর মাঝে ু কিছু লেখা লিখেছিও, যেমন_ 'ঘর' গল্পটি।
মুরশেদ : সেলিনা আপা, দীর্ঘ লেখকজীবনে অসংখ্য চরিত্রের জন্ম হয়েছে

ষ এর পর ২৬ পৃষ্ঠায়
ষ ১৫ এর পৃষ্ঠার পর

আপনার হাত দিয়ে। এমন কোনো চরিত্র কি আছে যা এখনও আপনাকে চমকে দেয়, ফিরে তাকাতে বাধ্য করে?
সেলিনা : আমার প্রিয় কিছু চরিত্র আছে। যেমন_ 'গায়ত্রী সন্ধ্যা'য় মঞ্জুলিকা চরিত্রটি। 'ভূমি ও কুসুম' উপন্যাসের একটি চরিত্র, নাম মনে করতে পারছি না এই মুহূর্তে, এছাড়া 'আণবিক আঁধার' উপন্যাসে প্রশান্তি চরিত্রটি আমার প্রিয়। আমার প্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা জিজ্ঞাসা আছে, উপন্যাসগুলোতে তারা হয়তো খুব বড় চরিত্র নয়, কিন্তু তারা বড় চরিত্রগুলোর পাশাপাশিই হাঁটে।
মুরশেদ : এমন কোনো চরিত্র কি আছে যাদের প্রতি আক্ষেপ বোধ করেন যে, ঠিকভাবে নির্মাণ করতে পারেননি?
সেলিনা : এমন কিছু চরিত্র তো থাকেই। কখনও মনে হয়, বুঝি আরেকটু সময় পেলে হতো, আবার কখনও মনে হয়_ আর কীই বা করতে পারতাম এই চরিত্র নিয়ে? তবে কয়েকটি চরিত্র নিয়ে আবার কাজ করার ইচ্ছা আমার আছে। এমনকি মাঝেমধ্যে ভাবি, কিছু উপন্যাসও আবার নতুন করে লিখব।
মুরশেদ : বিশ্বসাহিত্য প্রসঙ্গে আসি এবার। বিশ্বের উন্নত সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের পার্থক্য কোন জায়গায় বলে আপনার ধারণা?
সেলিনা : বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যের মৌলিক পার্থক্য অনুবাদে। আমাদের সাহিত্যের জীবনবোধের গভীরতা, উপলব্ধি তাদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। আমি কিছুদিন আগে আমেরিকা প্রবাসী থাইল্যান্ডের এক লেখকের বই পড়েছি, বেস্ট সেলার বই। পড়ে আমি হতাশ হয়েছি, কারণ ভাষা খুব জোলো। আমি মনে করি, অনুবাদ ভালো হয় না বলে আমাদের সাহিত্য বাইরে সেভাবে পরিচিতি পায় না।
মুরশেদ : সম্প্রতি ইতালিয়ান ভাষায় আপনার গল্প অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া ইংরেজিসহ ভারতীয় বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
সেলিনা : অন্য ভাষায় নিজের লেখা অনুবাদের বিষয়ে আমি কোনো পদক্ষেপই নিইনি কখনও। ইন্টারনেট থেকে পড়ে যারা আগ্রহী হয় তারা যোগাযোগ করে। এখানে কাউকে মানা তো করতে পারি না।
মুরশেদ : আপনার পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে বলুন?
সেলিনা : আমার পরবর্তী প্রজন্মে যারা লিখছে তারা ভালো করছে। নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকে ঝুঁকছে তারা। আমি আশাবাদী_ তারা তাদের সময়কে তুলে আনতে পারছে।
মুরশেদ : আগামী দিনে যারা লিখবে বলে ভাবছে তাদের প্রতি আপনি কী বলবেন?
সেলিনা : তেমন কিছু বলার নেই। তিনটি বিষয়ের প্রতি আমি জোর দিতে বলব_ ১. গভীর পর্যবেক্ষণশক্তি থাকতে হবে। ২. কঠিন পরিশ্রম করার ইচ্ছা থাকতে হবে ৩. সেই সঙ্গে প্রচুর পড়তে হবে। শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, এর বাইরে জ্ঞানের অন্যান্য দিক নিয়েও পড়াটা জরুরি।
মুরশেদ : সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের লেখক সত্তার জন্য কোনো প্রার্থনা করেন বা করেছেন কখনও?
সেলিনা : আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। তবে সেভাবে হয়তো ধর্মীয় আচার পালন করা হয় না। অনেক প্রার্থনাই করেছি ঈশ্বরের কাছে। কিন্তু আমার লেখক সত্তার জন্য কখনও প্রার্থনা করিনি। কারণ আমি কাজে বিশ্বাস করি। পরিশ্রমে বিশ্বাস করি। আমার কাজই আমাকে সাহায্য করবে। নিজের সঙ্গে লড়াই করে যেতে হবে। কারণ ঈশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছেন।
মুরশেদ : আমরা একেবারেই শেষে চলে এসেছি। আবার জন্মদিন প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আপনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে অসংখ্য শুভেচ্ছা। যেন আরও অনেক দিন লিখে যেতে পারেন এই কামনা করছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিনা : আপনাকেও ধন্যবাদ।

শ্রুতি উদ্ধার :আহ্মাদ শামীম

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites